০৪:০৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

আফগানিস্তানে বিশ বছর যুদ্ধ করে কী লাভ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের?

মু. মিজানুর রহমান মিজান
  • প্রকাশ: ০৩:২১:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ এপ্রিল ২০২১
  • / ৭০০ বার পড়া হয়েছে

আফগানিস্তানে বিশ বছর যুদ্ধ করে কী লাভ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের?

এপ্রিল ১৪, ২০২১, বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তানে যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথেই তালেবানরা উল্লাস প্রকাশ করেছে এবং একে নিজেদের জয় বলে দাবি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবশিষ্ট সৈন্যদের এ বছরের সেপ্তেম্বরের ১১ তারিখের মধ্যে ফিরিয়ে নিবে। যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ ডাব্লিউ বুশ। আপাতত আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্রদের নিয়ে যে যুদ্ধ চালিয়ে এসেছে বিশ বছর ধরে তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

বিশ বছর পর আফগানিস্তানে যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের, ব্রিটিশ সেনারাও ফিরে যাবে

যুক্তরাষ্টের প্রেসিডেন্ট জোসেফ রবিনেট বাইডেন জুনিয়র আফগানিস্তানে গত বিশ বছর ধরে চলে আসা যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা করেছেন। আফগানিস্তানের মাটিতে এখনো প্রায় ২,৫০০ থেকে ৩,৫০০ মার্কিন সৈন্য অবিস্থান করছে যা আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশে ফিরে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের পথেই হেটেছে যুক্তরাজ্যও, ব্রিটিশিদের অবশিষ্ট যে কয়জন সৈন্য আফগানিস্তানে এখনো আছে তাঁরাও এই সময়ের মধ্যেই আফগানিস্তান থেকে চলে যাবে। এ তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিসি, এবিসি, সিএনবিসিএ, নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিশ্বের বড়ো বড়ো গণমাধ্যম।

যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ফেরত নেওয়ার জন্য সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখই কেন বেছে নিয়েছে?

সেপ্টেম্বর ১১, ২০২১ তারিখ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সকল সৈন্য আফগানিস্তান ছেড়ে যাবেন। কেন তাঁরা এই সেপ্তেম্বর মাসের ১১ তারিখেই আফগানিস্তান ছাড়বেন আর অন্য কোনো দিনে নয় কেন? সত্যি কথা হলো এই দিনটি মার্কিনিদের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ বছর আগে ঠিক ঐ দিনই আল কায়েদা আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলা চালায় বলে দেশটি অভিযোগ করে আসছে, এমনকি এটি বিশ্বজুড়ে একরকম স্বীকৃতও। আমেরিকার ভাষ্যমতে, ওই সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করা ও নির্দেশনাদান হয়েছিল আফগানিস্তানে বসেই। আর এই হামলার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যৌথ হামলার মাধ্যমে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করা। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছিলেন যে, তালেবানকে ওই সময় আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িতও করে।

বিশ বছরে যুক্তরাষ্ট্র চড়া মূল্য দিয়েছে, হতাহত বেশি হয়েছেন আফগানরা

গত ২০ বছর ধরে যে আটলান্টিকের ওপারে থাকা দেশটি মধ্যপ্রাচ্যে এসে আফগানিস্তানে সামরিক এবং নিরাপত্তা তৎপরতার জন্য চড়া মূল্য দিতে দিয়েছে, খুইয়েছে নিজেদের অনেক সৈন্যের জীবন। বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ফ্র্যাংক গার্ডনার যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান-যুদ্ধ বিষয়ক এক পর্যালোচনায় বলেন, আজ (এপ্রিল ১৮ তারিখ) পর্যন্ত ২৩০০ মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে প্রাণ হারিয়েছে, আহত যারা হয়েছে তাঁদের সংখ্যা ২০,০০০। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, সেখানে ৪৫০ জন ব্রিটিশ সৈন্যও মারা গেছে। তবে মার্কিন সৈন্যদের নিহত হওয়ার সংখ্যা নিয়ে এবিসি নিউজ জানিয়েছে, ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানে য্যক্তরাষ্ট্রের ২৩১২ জন নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাইরেও আরও কিছু দেশের কয়েকশ সৈন্য মারা গেছেন দুই দশক ধরে চলা এই যুদ্ধে। তবে আফগানিস্তানে নিরাপত্তার অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্রের চালানো যুদ্ধে বহুগুণ বেশি নিহত হয়েছে আফগানরা।

বিবিসিতে ফ্র্যাংকলিন গার্ডনারের রিভিউতে তিনি লিখেছেন- এই যুদ্ধে ৬০ হাজারেরও বেশি আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মারা গেছেন। সাধারণ বেসামরিক আফগানের মৃত্যুর সংখ্যা তার দ্বিগুণ। অন্যদিকে এবিসির তিন সাংবাদিক লুইস মার্টিনেজ, ম্যাট সেলার এবং সিন্ডি স্মিথ তাঁদের যৌথ প্রতিবদেনে এপ্রিল ১৪, ২০২১ তারিখে লিখেছিলেন- এই যুদ্ধে ৩৫,০০০ থেকে ৪০,০০০ বেসামরিক আফগান নিহত হয়ে থাকতে পারেন। একই প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ডের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির রেফারেন্স দিয়ে বলেন, এই ইউনিভার্সিটির একটি প্রজেক্টের তথ্য অনুসারে ৪৩,০০০ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়।

ধারণা করা হয় যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে আফগানিস্তান-যুদ্ধে। কিন্তু কেন এত অর্থ ও সময় ব্যয় করতে হলে সেখানে? – এ প্রশ্নটি করা যতই সহজ, যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য উত্তর পাওয়াটা ততই কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ লোকজন কি এতে ক্ষুব্ধ নন কারণ এই অর্থের জোগান তো তাঁদের পকেট থেকেই আসে?

আফগানিস্তানে কেন যুদ্ধ করতে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশসমূহ?

পর্যালোচনা বা রিভিউ করে দেখা উচিৎ যে, কেন পশ্চিমা দেশগুলো দলবেঁধে আফগানিস্তানে গিয়েছিল এবং সেখানে কি এমন লক্ষ্য তারা অর্জন করতে চেয়েছিল? পশ্চিমাদের দাবি এবং বিশ্বসেরা গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে যা জানা যায় তা হলো-

১৯৯৬ থেকে শুরু করে পাঁচ বছর ধরে ওসামা বিন লাদেন ও তার নেতৃত্বে আল-কায়েদা আফগানিস্তানে শক্ত অবস্থান নেয়। ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদা বিভিন্ন দেশ থেকে কম-বেশি ২০,০০০ জিহাদি স্বেচ্ছাসেবী একত্র করে সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও প্রশিক্ষণ শুরু করে। ১৯৯৮ সালে আল-কায়েদা কেনিয়া এবং তানজানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায়। সে হামলায় নিহতের সংখ্যা ছিল ২৪৩।

আফগানিস্তানে নিজেদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিতে কোনো বাঁধার মুখেই পড়তে হয়নি ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদাকে কারণ এই আল-কায়েদার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ছিল তালিবানের। তালেবান এক গৃহযুদ্ধের মধ্যদিয়ে তখন আফগানিস্তানের সিংহাসনে বসে। ওই গৃহযুদ্ধ শুরু হয় যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের সৈন্য সেখান থেকে ফিরিয়ে নেয়।

আল-কায়েদা যখন ভয়ানক হয়ে উঠছিল তখন যুক্তরাষ্ট্র আল-কায়েদাকে আফগানিস্তান থেকে তাড়ানোর জন্য রাজী করাতে চেয়েছিল তালেবানকে কিন্তু সৌদি আরবের মধ্যস্ততায় সে-যাত্রায় কোনো লাভ হয়নি। অথচ ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা হয় যার সন্দেহের তীর ওঠে আল-কায়েদার দিকেই। বিশ্বইতিহাসে এই দিনটি ৯/১১ (নাইন/ইলেভেন) নামে পরিচিত হয়ে থাকবে। এবারেও সন্দেহভাজনদের ধরিয়ে দিতে তালেবানকে চাপ দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদেশগুলো; তালেবান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মাথা নত করেনি। এবার যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নর্দার্ন অ্যালায়েন্স নামে গঠিত একটি আফগান মিলিশিয়া দল অভিযান চালিয়ে তালেবানকে ক্ষমচ্যুত করে এবং আল-কায়েদাকেও জায়গা ছেড়ে পালাতে বাধ্য করে। তখন আল-কায়েদা পাকিস্তান ও আফগান সীমান্তে আশ্রয় নেয় বলে জানা যায়। এরপর থেকে আর কোনো আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সন্ত্রাসী হামলার নকশ বা পরিকল্পনা আফগানিস্তানে হয়নি- যা উল্লেখ করা হয় বিবিসির প্রতিবেদনে।

আফগানিস্তান-যুদ্ধে পশ্চিমাদের সাফল্য ও বাস্তবতা

তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং এর পর থেকে আফগানিস্তানের মাটিতে কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা না হওয়া নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র ও এই দেশটির সাথে যেসব দেশ ছিল তাদের বড়োমাপের সাফল্য। কিন্তু তা আফগানিস্তানে নিহত হওয়া সামরিক ও বেসামরিক মানুষের কাছে তেমন কিছুই না। বিশ্বমিডিয়া এসেছে, ২০২০ সালেও করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে আফগানিস্তানে বিভিন্ন বিস্ফোরকের আঘাতে নিহত হওয়ার সংখ্যা বেশি। গেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী দমন করতে পুরোপুরি সফল হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র তো ঘোষণা দিয়েছেই যে, ২০২১ এর সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখ তাদের সব সৈন্য ফিরিয়ে নিবে; এই ফাঁকে কি আবারও ওই সব সংগঠন নিজেদের কর্মপরিধি বাড়াবে না? যুক্তরাষ্ট্র এক রকম অপারগ হয়েই যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা দিলো কি না সেটিও ভেবে দেখা দরকার। যারা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিয়ে সব সময় বিশ্লেষণ করে থাকেন তাঁদের অনেকে যুদ্ধের শুরুর দিকেই বলেছিলেন, আগামী ২০ বছরের মধ্যে আফগানিস্তানের বিভিন্ন অংশ তালেবান নিজেদের ক্ষমতায় নিবে। পাশাপাশি এটিও ধারণা করা হচ্ছে যে, তালেবানকেই দেশের নাগরিকদের সাথে তাল মিলিয়ে বা সোজা কথায় আপোষ করে চলতে হবে; আফগানিস্তানের মানুষ আগের থেকে এখন অনেকটাই লিবারেল।

আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কী?

বিভিন্নমহল থেকে মন্তব্য আসছে যে, আফগানিস্তানে নিজেদের প্রভাব খাটাতে ব্যর্থ হয়ে এখন লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র পালিয়ে যাচ্ছে নাকি নিজের ইচ্ছাতে পরিস্থিতি ভালো বলেই যাচ্ছে সেটি আপাতত খুঁড়ে দেখার সক্ষমতা আলোচক-সমালোচকদের নেই। সত্যিই যদি তালেবান আবারো আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তখন এই গোষ্ঠীর সাথে আল-কায়েদা কিংবা অন্য যেসব গোষ্ঠী রয়েছে তাদের সম্পর্কের ধরণ কেমন হবে সেটিও দেখার বিষয়। আবার আফগানিস্তানে পরিস্থিতি নেতিবাচক হতে থাকলে সে সময় নিশ্চয়ই যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা বসে থাকতে চাইবে না যেহেতু এখানে তাদের ব্যয় হয়েছে বিশটি বছর, প্রচুর অর্থ ও প্রাণ। আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনই মন্তব্য করা বা ভবিষ্যৎবাণী করাটা সম্ভব নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তানে যুদ্ধ বন্ধের যে ঘোষণা দিয়েছেন তা নিশ্চয়ই তাঁর একার সিদ্ধান্ত বা একদিনের সিদ্ধান্ত নয়। এর পেছনেও  বড়ো একটি সময় ব্যয় করে অনেক পর্যালোচনা করতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা দপ্তরসমূহকে। বিশ বছর ধরে চলমান যুদ্ধের সমাপ্তির পর দেখার বিষয় আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যায়।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মু. মিজানুর রহমান মিজান

মু. মিজানুর রহমান মিজান একজন স্বাধীন শিক্ষামূলক লেখক। তিনি শিক্ষা গবেষণায় বেশ আগ্রহী। যৌথভাবে কিছু গবেষণায়ও অংশ নিয়েছেন।
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে
তাহসান খান এবং মুনজেরিন শহীদের দুটি প্রফেশনাল কমিউনিকেশন কোর্স করুন ২৮% ছাড়ে

২৮℅ ছাড় পেতে ৩০/০৬/২০২৪ তারিখের মধ্যে প্রোমো কোড “professional10” ব্যবহার করুন। বিস্তারিত জানতে ও ভর্তি হতে ক্লিক করুন এখানে

আফগানিস্তানে বিশ বছর যুদ্ধ করে কী লাভ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের?

প্রকাশ: ০৩:২১:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ এপ্রিল ২০২১

এপ্রিল ১৪, ২০২১, বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তানে যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথেই তালেবানরা উল্লাস প্রকাশ করেছে এবং একে নিজেদের জয় বলে দাবি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবশিষ্ট সৈন্যদের এ বছরের সেপ্তেম্বরের ১১ তারিখের মধ্যে ফিরিয়ে নিবে। যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ ডাব্লিউ বুশ। আপাতত আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্রদের নিয়ে যে যুদ্ধ চালিয়ে এসেছে বিশ বছর ধরে তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

বিশ বছর পর আফগানিস্তানে যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের, ব্রিটিশ সেনারাও ফিরে যাবে

যুক্তরাষ্টের প্রেসিডেন্ট জোসেফ রবিনেট বাইডেন জুনিয়র আফগানিস্তানে গত বিশ বছর ধরে চলে আসা যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা করেছেন। আফগানিস্তানের মাটিতে এখনো প্রায় ২,৫০০ থেকে ৩,৫০০ মার্কিন সৈন্য অবিস্থান করছে যা আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশে ফিরে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের পথেই হেটেছে যুক্তরাজ্যও, ব্রিটিশিদের অবশিষ্ট যে কয়জন সৈন্য আফগানিস্তানে এখনো আছে তাঁরাও এই সময়ের মধ্যেই আফগানিস্তান থেকে চলে যাবে। এ তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিসি, এবিসি, সিএনবিসিএ, নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিশ্বের বড়ো বড়ো গণমাধ্যম।

যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ফেরত নেওয়ার জন্য সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখই কেন বেছে নিয়েছে?

সেপ্টেম্বর ১১, ২০২১ তারিখ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সকল সৈন্য আফগানিস্তান ছেড়ে যাবেন। কেন তাঁরা এই সেপ্তেম্বর মাসের ১১ তারিখেই আফগানিস্তান ছাড়বেন আর অন্য কোনো দিনে নয় কেন? সত্যি কথা হলো এই দিনটি মার্কিনিদের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ বছর আগে ঠিক ঐ দিনই আল কায়েদা আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলা চালায় বলে দেশটি অভিযোগ করে আসছে, এমনকি এটি বিশ্বজুড়ে একরকম স্বীকৃতও। আমেরিকার ভাষ্যমতে, ওই সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করা ও নির্দেশনাদান হয়েছিল আফগানিস্তানে বসেই। আর এই হামলার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যৌথ হামলার মাধ্যমে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করা। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছিলেন যে, তালেবানকে ওই সময় আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িতও করে।

বিশ বছরে যুক্তরাষ্ট্র চড়া মূল্য দিয়েছে, হতাহত বেশি হয়েছেন আফগানরা

গত ২০ বছর ধরে যে আটলান্টিকের ওপারে থাকা দেশটি মধ্যপ্রাচ্যে এসে আফগানিস্তানে সামরিক এবং নিরাপত্তা তৎপরতার জন্য চড়া মূল্য দিতে দিয়েছে, খুইয়েছে নিজেদের অনেক সৈন্যের জীবন। বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ফ্র্যাংক গার্ডনার যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান-যুদ্ধ বিষয়ক এক পর্যালোচনায় বলেন, আজ (এপ্রিল ১৮ তারিখ) পর্যন্ত ২৩০০ মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে প্রাণ হারিয়েছে, আহত যারা হয়েছে তাঁদের সংখ্যা ২০,০০০। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, সেখানে ৪৫০ জন ব্রিটিশ সৈন্যও মারা গেছে। তবে মার্কিন সৈন্যদের নিহত হওয়ার সংখ্যা নিয়ে এবিসি নিউজ জানিয়েছে, ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানে য্যক্তরাষ্ট্রের ২৩১২ জন নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাইরেও আরও কিছু দেশের কয়েকশ সৈন্য মারা গেছেন দুই দশক ধরে চলা এই যুদ্ধে। তবে আফগানিস্তানে নিরাপত্তার অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্রের চালানো যুদ্ধে বহুগুণ বেশি নিহত হয়েছে আফগানরা।

বিবিসিতে ফ্র্যাংকলিন গার্ডনারের রিভিউতে তিনি লিখেছেন- এই যুদ্ধে ৬০ হাজারেরও বেশি আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মারা গেছেন। সাধারণ বেসামরিক আফগানের মৃত্যুর সংখ্যা তার দ্বিগুণ। অন্যদিকে এবিসির তিন সাংবাদিক লুইস মার্টিনেজ, ম্যাট সেলার এবং সিন্ডি স্মিথ তাঁদের যৌথ প্রতিবদেনে এপ্রিল ১৪, ২০২১ তারিখে লিখেছিলেন- এই যুদ্ধে ৩৫,০০০ থেকে ৪০,০০০ বেসামরিক আফগান নিহত হয়ে থাকতে পারেন। একই প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ডের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির রেফারেন্স দিয়ে বলেন, এই ইউনিভার্সিটির একটি প্রজেক্টের তথ্য অনুসারে ৪৩,০০০ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়।

ধারণা করা হয় যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে আফগানিস্তান-যুদ্ধে। কিন্তু কেন এত অর্থ ও সময় ব্যয় করতে হলে সেখানে? – এ প্রশ্নটি করা যতই সহজ, যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য উত্তর পাওয়াটা ততই কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ লোকজন কি এতে ক্ষুব্ধ নন কারণ এই অর্থের জোগান তো তাঁদের পকেট থেকেই আসে?

আফগানিস্তানে কেন যুদ্ধ করতে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশসমূহ?

পর্যালোচনা বা রিভিউ করে দেখা উচিৎ যে, কেন পশ্চিমা দেশগুলো দলবেঁধে আফগানিস্তানে গিয়েছিল এবং সেখানে কি এমন লক্ষ্য তারা অর্জন করতে চেয়েছিল? পশ্চিমাদের দাবি এবং বিশ্বসেরা গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে যা জানা যায় তা হলো-

১৯৯৬ থেকে শুরু করে পাঁচ বছর ধরে ওসামা বিন লাদেন ও তার নেতৃত্বে আল-কায়েদা আফগানিস্তানে শক্ত অবস্থান নেয়। ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদা বিভিন্ন দেশ থেকে কম-বেশি ২০,০০০ জিহাদি স্বেচ্ছাসেবী একত্র করে সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও প্রশিক্ষণ শুরু করে। ১৯৯৮ সালে আল-কায়েদা কেনিয়া এবং তানজানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায়। সে হামলায় নিহতের সংখ্যা ছিল ২৪৩।

আফগানিস্তানে নিজেদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিতে কোনো বাঁধার মুখেই পড়তে হয়নি ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদাকে কারণ এই আল-কায়েদার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ছিল তালিবানের। তালেবান এক গৃহযুদ্ধের মধ্যদিয়ে তখন আফগানিস্তানের সিংহাসনে বসে। ওই গৃহযুদ্ধ শুরু হয় যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের সৈন্য সেখান থেকে ফিরিয়ে নেয়।

আল-কায়েদা যখন ভয়ানক হয়ে উঠছিল তখন যুক্তরাষ্ট্র আল-কায়েদাকে আফগানিস্তান থেকে তাড়ানোর জন্য রাজী করাতে চেয়েছিল তালেবানকে কিন্তু সৌদি আরবের মধ্যস্ততায় সে-যাত্রায় কোনো লাভ হয়নি। অথচ ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা হয় যার সন্দেহের তীর ওঠে আল-কায়েদার দিকেই। বিশ্বইতিহাসে এই দিনটি ৯/১১ (নাইন/ইলেভেন) নামে পরিচিত হয়ে থাকবে। এবারেও সন্দেহভাজনদের ধরিয়ে দিতে তালেবানকে চাপ দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদেশগুলো; তালেবান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মাথা নত করেনি। এবার যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নর্দার্ন অ্যালায়েন্স নামে গঠিত একটি আফগান মিলিশিয়া দল অভিযান চালিয়ে তালেবানকে ক্ষমচ্যুত করে এবং আল-কায়েদাকেও জায়গা ছেড়ে পালাতে বাধ্য করে। তখন আল-কায়েদা পাকিস্তান ও আফগান সীমান্তে আশ্রয় নেয় বলে জানা যায়। এরপর থেকে আর কোনো আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সন্ত্রাসী হামলার নকশ বা পরিকল্পনা আফগানিস্তানে হয়নি- যা উল্লেখ করা হয় বিবিসির প্রতিবেদনে।

আফগানিস্তান-যুদ্ধে পশ্চিমাদের সাফল্য ও বাস্তবতা

তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং এর পর থেকে আফগানিস্তানের মাটিতে কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা না হওয়া নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র ও এই দেশটির সাথে যেসব দেশ ছিল তাদের বড়োমাপের সাফল্য। কিন্তু তা আফগানিস্তানে নিহত হওয়া সামরিক ও বেসামরিক মানুষের কাছে তেমন কিছুই না। বিশ্বমিডিয়া এসেছে, ২০২০ সালেও করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে আফগানিস্তানে বিভিন্ন বিস্ফোরকের আঘাতে নিহত হওয়ার সংখ্যা বেশি। গেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী দমন করতে পুরোপুরি সফল হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র তো ঘোষণা দিয়েছেই যে, ২০২১ এর সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখ তাদের সব সৈন্য ফিরিয়ে নিবে; এই ফাঁকে কি আবারও ওই সব সংগঠন নিজেদের কর্মপরিধি বাড়াবে না? যুক্তরাষ্ট্র এক রকম অপারগ হয়েই যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা দিলো কি না সেটিও ভেবে দেখা দরকার। যারা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিয়ে সব সময় বিশ্লেষণ করে থাকেন তাঁদের অনেকে যুদ্ধের শুরুর দিকেই বলেছিলেন, আগামী ২০ বছরের মধ্যে আফগানিস্তানের বিভিন্ন অংশ তালেবান নিজেদের ক্ষমতায় নিবে। পাশাপাশি এটিও ধারণা করা হচ্ছে যে, তালেবানকেই দেশের নাগরিকদের সাথে তাল মিলিয়ে বা সোজা কথায় আপোষ করে চলতে হবে; আফগানিস্তানের মানুষ আগের থেকে এখন অনেকটাই লিবারেল।

আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কী?

বিভিন্নমহল থেকে মন্তব্য আসছে যে, আফগানিস্তানে নিজেদের প্রভাব খাটাতে ব্যর্থ হয়ে এখন লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র পালিয়ে যাচ্ছে নাকি নিজের ইচ্ছাতে পরিস্থিতি ভালো বলেই যাচ্ছে সেটি আপাতত খুঁড়ে দেখার সক্ষমতা আলোচক-সমালোচকদের নেই। সত্যিই যদি তালেবান আবারো আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তখন এই গোষ্ঠীর সাথে আল-কায়েদা কিংবা অন্য যেসব গোষ্ঠী রয়েছে তাদের সম্পর্কের ধরণ কেমন হবে সেটিও দেখার বিষয়। আবার আফগানিস্তানে পরিস্থিতি নেতিবাচক হতে থাকলে সে সময় নিশ্চয়ই যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা বসে থাকতে চাইবে না যেহেতু এখানে তাদের ব্যয় হয়েছে বিশটি বছর, প্রচুর অর্থ ও প্রাণ। আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনই মন্তব্য করা বা ভবিষ্যৎবাণী করাটা সম্ভব নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তানে যুদ্ধ বন্ধের যে ঘোষণা দিয়েছেন তা নিশ্চয়ই তাঁর একার সিদ্ধান্ত বা একদিনের সিদ্ধান্ত নয়। এর পেছনেও  বড়ো একটি সময় ব্যয় করে অনেক পর্যালোচনা করতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা দপ্তরসমূহকে। বিশ বছর ধরে চলমান যুদ্ধের সমাপ্তির পর দেখার বিষয় আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যায়।